হালাল-হারাম

ইসলামে সঙ্গীত হারাম নয় বরং হালাল – হাদিস


যারা গান ও বাদ্যযন্ত্রকে ইসলামে হারাম বলে ফতোয়া দেন তারা নিচের হাদিসগুলোর কী ব্যাখ্যা দিবেন?

১. রসুলাল্লাহর নারী সাহাবি রুবাই বিনতে মুআব্বিয ইবনু আফরা (রা.) বলেন, “আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী (সা.) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার কাছে বসে আছ। সে সময়ে মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত আমার বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল। তাদের একজন গাচ্ছিল, আমাদের মধ্যে এক নবী আছেন, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন। তখন রসুলুল্লাহ্ বললেন, এ কথাটি বাদ দাও, আগে যা গাইছিলে তাই গাও (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫১৪৭)।”

২. আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার রসুলাল্লাহ কোনো এক সফরে যাচ্ছিলেন। জনৈক উট চালক উটের রশি ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আর গান গাচ্ছিল। গান গেয়ে সে উটকে জোরে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করছিল। এই গানগুলোকে বলা হয় হুদী সঙ্গীত। উটের পিঠে আরোহী ছিলেন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণ। স্ত্রীগণের উটটি রসুলাল্লাহর উটকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তখন তিনি গায়ককে লক্ষ্য করে বললেন, আনযাশাহ! সাবধানে চলো; এই কাচের পাত্রদের সঙ্গে কোমল আচরণ করো। (মুসনাদে আহমদ, ৩:১৭২, ১৮৭, ২০২)।

৩. একবার আরবের একটি জাতীয় উৎসবের দিন ‘বুয়াস দিবস’- এ দুটো মেয়ে রসুলাল্লাহর ঘরে দফ ও তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছিল। আম্মা আয়েশাও (রা.) গান শুনছিলেন। এমন সময় তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) সেখানে আসেন এবং আম্মা আয়েশাকে (রা.) তিরস্কার করেন। তখন আল্লাহর নবী আবু বকরের (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবু বকর! তাদেরকে তাদের কাজ করতে দাও” (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৯৮৭)।

৪. আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে আয়েশা (রা.) এর প্রত্যাবর্তনের পর রাসুলাল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কি মেয়েটিকে তার স্বামী গৃহে রেখে এসেছো?” উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। পুনরায় রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এমন কাউকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছ যে গান গাইতে পারে?” আয়েশা (রা.) বললেন, “না”। রাসুলাল্লাহ বললেন, “তুমি তো জান আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়” (ইকদ আল ফরিদ)।

৫. আবু বোরায়দা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) কোনো একটি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী আসহাব মহানবী (স.) এর সামনে এসে বললেন যে- ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি মানত করেছিলাম যে, আপনাকে নিরাপদে আল্লাহ ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ বাজিয়ে গান গাইব।’ মহানবী (স.) বললেন, ‘যদি তুমি মানত করে থাক তাহলে বাজাও। মানত পূর্ণ কর। তারপর মেয়েটি দফ বাজিয়ে গান গাইতে লাগল।’ [তিরমিজি ২য় খণ্ডের ২০৯-২১০ পৃষ্ঠা, মেশকাত শরিফের ৫৫৫ পৃষ্ঠা ও আবু দাউদ শরিফ]।

 

“হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরাফুল একেলা আমি”

আসুন একটি ঝরাফুলের মূল্যায়ন করি। “একদিন বিখ্যাত মুসলিম মহিলা সঙ্গীতজ্ঞ জামিলা মদীনায় একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) ইবনে আবু তালিবের সম্মানার্থে। এ অনুষ্ঠানে সঙ্গীতজ্ঞা জামিলার বাসভবনে যে সমস্ত মেয়েরা সঙ্গীত প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিল তারা সুন্দর পোশাকে বিকশিত হয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং এতে শ্রোতা ও শিল্পীদের মধ্যে কোনো পর্দা টানানো ছিল না (কিতাব আল আঘানী, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৬)।

উল্লেখ্য, মুসলিম সভ্যতার সঙ্গীতের ইতিহাসের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো – আবুল ফারাজ আল ইস্পাহানী রচিত (মৃত্যু ৯৬৭) কিতাব আল আঘানী। এই বিরাট পুস্তকটি ২০ খণ্ডে রচিত। (ছবিতে ঐ গ্রন্থের মধ্যে অঙ্কিত মুসলিম চিত্রকরদের আঁকা মানুষের ছবিও দেখা যাচ্ছে।)

১. যে সময়ের কথা হচ্ছে রসুলের (সা.) সাহাবীদের অনেকেই তখন জীবিত অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা নিয়ে যে সমাজটি মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে সমাজের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এ ঘটনার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। রসুলাল্লাহর (সা.) যে সাহাবীর সম্মানার্থে সঙ্গীতানুষ্ঠানটি করা হয়েছে তিনি এমন এক ব্যক্তি যার জন্ম ইসলামের গর্ভে, আরব্য জাহেলিয়াতে নয়। তাঁর বাবা ছিলেন রসুলাল্লাহর (সা.) আপন চাচাতো ভাই যিনি মুতার যুদ্ধের অন্যতম শহীদ সেনাপতি। তাঁর চাচা ছিলেন চতুর্থ খলিফা, রসুলাল্লাহর জামাতা আলী (রা.)। সুতরাং ১৪০০ বছর পরে এসে আমরা তাকে সঙ্গীত হালাল না হারাম এ ফতোয়া শেখাতে পারি না।

২. যিনি সঙ্গীতানুষ্ঠানটি করলেন তিনি একজন ‘মুসলিম নারী’। তিনি ঐ দিনই প্রথম গান করেন নি, তিনি ঐ সময়ের একজন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়িকা ছিলেন। তিনি সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে কোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন নি, বরং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সাহাবীদের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করেছেন তাও এ ঘটনায় সুস্পষ্ট।

৩. সঙ্গীতচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপও সমাজে বিদ্যমান ছিল। জামিলার প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত শিক্ষালয়ে মেয়েরা গান শিখতে আসতেন, অর্থাৎ তাদের পারিবারিক সম্মতি ছিল। মনে রাখতে হবে, এই পরিবারগুলো মদীনার মুসলিম পরিবার যে পবিত্র শহর থেকে ইসলামের কুসুম বিকশিত হয়ে তদানীন্তন বিশ্বকে সভ্যতা শিক্ষা দিয়েছিল।

ঐ সমাজের মানুষগুলো প্রত্যেকেই ইসলামের রীতি নীতি ভালোভাবে জানতেন। ইসলাম তখনও আলেমদের সম্পত্তি হয় নি। মানুষগুলো সরাসরি রসুলাল্লাহ (সা.) তথা তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে ব্যবহারিকভাবে ইসলামের রীতিনীতির জ্ঞান, শিক্ষা ও যাবতীয় সংস্কার লাভ করেছিলেন। তাদের ঐ সমাজে একটি ‘নিষিদ্ধ সংস্কৃতির’ চর্চা কোনো অবস্থাতেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারতো না। কারণ সে সময়ের মুসলিমরা নিবীর্য ছিলেন না।

৪. মেয়েগুলো এসে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে (Public Function) গেয়েছিলেন। সুতরাং এটি নিশ্চিত যে তারা প্রাপ্তবয়স্কাই ছিলেন। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দৃষ্টিনন্দন পোশাক পরে সঙ্গীতানুষ্ঠানে গান করতেন। প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েরা পরপুরুষের নজর বাঁচিয়ে গৃহে অন্তরীণ থাকবেন এ শরিয়াতের যারা স্রষ্টা তখনও তারা পয়দা হন নি। তাই মেয়ে শিল্পীদেরকে ‘দাইয়্যুস’ বলে ফতোয়া দেওয়ার কেউ ছিল না।

৫. অনুষ্ঠানটিতে শ্রোতা ও ‘নারী শিল্পীদের’ মধ্যে কোনো পর্দা টাঙানো ছিল না। এ তথ্যটি উল্লেখ করে ইতিহাসবেত্তা বোঝাতে চাইছেন যে, সমাবেশস্থলে নারী-পুরুষের মধ্যে পর্দা টানানোর প্রচলন হয় আরো পরে। মসজিদে নববীতে, জুমায়, সালাতের সময় বা যে কোনো স্থানে নারী-পুরুষরা একত্র হয়ে রসুলের (সা.) আলোচনা শুনতেন সেখানেও নারী-পুরুষের মাঝে কোনো পর্দা টানানোর চর্চা ছিল না।

এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন ইসলামে সঙ্গীত চর্চা নিষিদ্ধ না প্রসিদ্ধ, ঘৃণিত না সমাদৃত। আমি সিদ্ধান্ত দেব না। দিলে অনেকেই বলবেন, আপনি ইসলামের কী বোঝেন? আপনি কি মুফতি? তাদের এতসব ‘গরুত্বপূর্ণ’ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার যোগ্যতা অধমের নেই।

ইসলাম ও অইসলাম

খ্রিষ্টান-কাফের-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করা কতটুকু ইসলাম সম্মত?


“কোনো ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে তাকে হত্যা করা কি ইসলামের বিধান” – ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও মুফতি সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি এ প্রশ্নটি ফেসবুকে করেছিলাম। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পেছনেও একটি ঘটনা আছে। তা হলো- ঐ দিন দুপুরে আমি একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৪ মার্চ নোয়াখালীতে যে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেখানে ইসলামের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা ও মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে কীভাবে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে অপব্যবহার করা হয়েছে সেটা বলার চেষ্টা করি। আমাকে ইসলামের কথা বলতে শুনে সেই জনপ্রতিনিধি রেগে আগুন। তিনি বলেন, “আপনি ইসলামের কথা বলার কে? আপনি কি মুফতি? ইসলামের কথা বলবেন মুফতিরা।” তার অগ্নিমূর্তি দেখে বুঝলাম, আমি কী কথা বলছি, কোর’আনের কথা বলছি না নিজের বানানো কথা বলছি সেটা তিনি বিবেচনাও করতে নারাজ। একজন শিক্ষিত সচেতন সমাজনেতা যদি ধর্মীয় বিষয়ে এমন অন্ধ, বিচারবোধহীন ও যুক্তিহীন হতে পারেন তাহলে দেশের আপামর ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বার বার ধর্মের নামে অধর্ম করা হবে এতে আর আশ্চর্যের কী? মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ অধর্ম তো ধর্মের নামেই করা হয়েছে।
ফেসবুকে একটি কমেন্ট আসলো, “মুসলিম সমাজ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে আপনাদেরকে কতল করা অত্যন্ত হালাল।” কারা এই ‘মুসলিম সমাজ’ এ প্রশ্নটি আর করলাম না। তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, “এ আইন আপনি কোথায় পেলেন? ব্যক্তিগতভাবে কোনো মানুষকে মারা তো কখনো বৈধ হতে পারে না। কেউ অপরাধ করলে সেটার বিচার রাষ্ট্র করবে। আমরা রসুলের জীবনীতে দেখতে পাই যতদিন রসুল রাষ্ট্রশক্তি পান নাই ততদিন তিনি কাউকে দণ্ডও দেন নাই।”
এর জবাবে তিনি বলেন, “এই আইন উলুমুল ফিকাহ থেকে প্রাপ্ত। উমর (রা.) এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল আপনি ইতিহাসে পান নি? তবে কথা হলো, এদেশ তো ধর্মনিরপেক্ষ। তাই আমাদের ধর্মের বিকৃতির বিচার আমাদেরই করতে হয়। এখানে রাষ্ট্রের নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই, কারণ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ।”
উলুমুল ফিকাহ মোতাবেক এই সিদ্ধান্তে তিনি এসেছেন যে, কেউ যদি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তাহলে তাকে হত্যা করে ফেলা ‘অত্যন্ত হালাল’ হবে এবং সেটার বাস্তবায়ন ব্যক্তিগতভাবেই করা যাবে। অর্থাৎপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করছেন। এই লেখাটি চলমান থাকা অবস্থায় খবর পেলাম কুড়িগ্রামে একজন ধর্মান্তরিত নির্বিরোধী খ্রিষ্টান মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করার সময় খুনীরা “আল্লাহু আকবার” বলে তাকবির দিচ্ছিল। ইতোপূর্বে ভিন্ন ধর্মের ও ভিন্ন মাজহাবের অনেকেই এভাবে নিহত হয়েছেন, ইসলাম বিদ্বেষী লেখালিখি করার অভিযোগেও অনেককেই প্রাণ হারাতে হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডকে ফেসবুকে কমেন্টকারী ভদ্রলোকের মতো অনেকেই ইসলাম-সম্মত বলে মনে করেন। তাই এ বিষয়ে লেখাটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করছি। কেননা ইসলামের দলিলগুলো ঘাটলে এর ব্যতিক্রমী এমনকি বিপরীতমুখী তথ্যও দেখতে পাওয়া যায়। তাই ইসলামী শরিয়তের বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছি।
ওমর (রা.) কর্তৃক মোনাফেক হত্যার অপব্যাখ্যা
এখানে ওমর (রা.) কর্তৃক এক ব্যক্তিকে হত্যার প্রসঙ্গটি এসেছে। যদিও ইবনে হাজার আসকালানি, ইবনে কাসীরের মতো মোফাসসির মোহাদ্দিসগণ এই ঘটনাকে “প্রামাণ্য নয়” বলেছেন। এটি বদর যুদ্ধের আগের ঘটনা, ইসলামের বিধিবিধান তখনও সেভাবে নাজেল হয় নি। একজন ইহুদি ও একজন আনসার মুনাফেক তাদের একটি বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য কার কাছে যাবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে। ইহুদি চায় রসুলাল্লাহর দরবারে যেতে, কিন্তু মোনাফেকটি মনে করে সেক্ষেত্রে রায় তার প্রতিকূলে যাবে। তারা এক ইহুদি গোত্রপ্রধানের কাছে যায়। কিন্তু তার রায়ে মোনাফেকটি সন্তুষ্ট হতে পারে না। এরপর সে ইহুদি কবি কা’ব বিন আশরাফের কাছে গিয়ে মকদ্দমা পেশ করতে চায়। কিন্তু ইহুদির পিড়াপিড়িতে এক পর্যায়ে তারা রসুলাল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়। রসুলাল্লাহর (সা.) দেওয়া ফায়সালা সেই আনসারের মনঃপুত হয় না। সে রায় পুনর্বিবেচনা করার আবেদন নিয়ে ওমরের (রা.) কাছে যায়।
ওমর (রা.) ঐ মোনাফেককে জিজ্ঞাসা করেন যে, “অর্থাৎ তুমি রসুলাল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নও এবং আমাকে বলছ তাঁর সিদ্ধান্তকে উল্টে দেওয়ার জন্য?” আনসার লোকটি বলল, “ঠিক তাই।” ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি মুসলিম?” লোকটি জবাব দিল, “জ্বি আমি মুসলিম।” তখন ওমর (রা.) বলেন, “আমি শিগগিরই তোমাকে এমন ফায়সালা দিচ্ছি যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে।” তিনি ঘরের ভিতরে গিয়ে একটি তলোয়ার নিয়ে আসেন এবং লোকটিকে হত্যা করে ফেলেন। (Hadrat Abu Bakr, Umar, Usman, Ali (ra) 4 Vol. Set – প্রফেসর মাসুল আল হাসান, পাকিস্তান) ঘটনাটি শুনে আল্লাহর রসুল নীরব হয়ে যান এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ সুরা নিসার ৬১-৬৩ নম্বর আয়াত নাজেল করেন। তিনি বলেন, যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসুলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আপতিত হয়, তবে তাতে কি হল!
অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। [সুরা নিসা: ৬৩] আল্লাহর রসুল বর্তমান থাকা অবস্থায় ওমর (রা.) ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে কাজটি করলেন তাকে ভিত্তি করে যে কাউকে মোনাফেক বা মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করে ফেলার মতো গুরুতর বিধান জারি করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? লক্ষ্যণীয় যে, ওমর (রা.) রসুলাল্লাহর অনুমতি বা নির্দেশে কাজটি করেন নি। পরবর্তীতে বহুবার তিনি মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন, কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁকে নিবৃত করেছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাদেরকে হত্যা না করে উপেক্ষা করতে এবং সদুপদেশ দিয়ে এমন কথা বলতে নির্দেশ দিচ্ছেন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। কোনো ব্যক্তির নিজেকে মুসলিম দাবি করা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমাদের দেশে প্রায়ই এভাবে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করেন। কষ্টের বিষয় হলো এ জাতীয় জঘন্য কাজ অনেক সময় ধর্মের নাম নিয়ে জেহাদ মনে করে করা হয়।
আমাদের দেশে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শাসনকাঠামো রয়েছে এটা বাস্তবতা। তাকে পাশ কাটিয়ে আরেকটি বিচারব্যবস্থা সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা কোনো আইনেই বৈধ হয় না, রসুলাল্লাহর সুন্নাহ মোতাবেকও সঠিক হয় না। ইসলামের মূল যে উদ্দেশ্য ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ – এই সমান্তরাল ফতোয়া কার্যকরের দ্বারা সেই শান্তিও আসবে না। অর্থাৎ কাজটি অর্থহীন হবে। যখন রসুলাল্লাহ রাষ্ট্রশক্তি পান নি, মক্কায় ছিলেন তখন কি মুসলিমরা অত্যাচারী, রসুলকে গালিগালাজকারী কাফেরদের কাউকে হত্যা করেছিলেন? আজ যেমন ধর্মীয় আন্দোলনের নামে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে নির্দোষ নারী-পুরুষ-শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সেভাবে তিনি কি কাউকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন? দোকানপাট রাস্তাঘাট ভাঙচুর করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন? না, এমন একটা ঘটনারও উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবেন না।
রসুলাল্লাহর সুন্নাহ অনুসরণ করলে প্রথমে তাদের উচিত রসুল যেভাবে আল্লাহর হুকুম মানার সুফল, অমান্য করার কুফল, সত্য – মিথ্যার পার্থক্য, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটিগুলো অর্থাৎ নিজের আদর্শকে প্রকাশ্যে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মদীনায় জনসমর্থন অর্জন করেছিলেন, সেভাবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসমর্থন সৃষ্টি করা। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্রশক্তি পেলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য দূর করা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তা না করে, বৃহত্তর জনগণকে অন্ধকারে রেখে গুপ্তহত্যা করে ভীতি ও ত্রাসের দ্বারা যে ব্যবস্থা তারা ‘শরিয়ত’ প্রতিষ্ঠার নামে করতে চান সেটা কতটুকু কোর’আন-সুন্নাহসম্মত সেটা বিজ্ঞ আলেমগণ রায় দেবেন। ফতোয়া যেন কোর’আন ও রসুলাল্লাহর নীতিকে লঙ্ঘন না করে।
সুদানের শরিয়া আদালত
সুদানের শরিয়া আদালতবর্তমানে কাফের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে আইএস শাসিত এলাকায়, তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় এবং এশিয়া আফ্রিকার যেসব দেশে ‘শরিয়াহ আদালত’ রয়েছে সবখানে। আমাদের দেশেও যারা ‘শরিয়ত’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জেহাদ’ বা রাজনীতি করছে তারাও সেই জবরদস্তিমূলক মোল্লাতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করতে চায় যার চিন্তাধারা, আকীদা অনেক ক্ষেত্রেই কোর’আনে ও রসুলের সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আর কে মুসলিম, কে কাফের, কোনটা ইসলাম, কোনটা অনৈসলামিক তা সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার তাদেরকে কে দান করেছে? তাদের উলুমুল ফেকাহতে যেটা বলা হবে সেটা ইসলাম নাকি কোর’আন হাদীসে, রসুলের জীবনে যে ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ইসলাম? এই সিদ্ধান্ত এখন মুসলিম জাতিকে গ্রহণ করতে হবে। যদি আমরা ঐ মাদ্রাসাশিক্ষিত মুফতি, আল্লামা সাহেবদের কথাকেই ইসলাম বলে মনে করি, যদি কোর’আন হাদীসের বিরুদ্ধেও তারা কোনো ফতোয়া দেন আর সেটাকেই শিরোধার্য মনে করি তাহলে তাদের অনুসারীরা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। কারণ আল্লাহর রসুল বিদায় হজ্বের ভাষণে বলে গেছেন, “দুটো বস্তু আমি রেখে যাচ্ছি যা তোমরা আকড়ে ধরে রাখলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। সে বস্তুদুটো হচ্ছে আল্লাহর কেতাব আর আমার সুন্নাহ।”
রসুলাল্লাহ আরো বলে গেছেন, “কোনো বিষয়ে যদি আমার বক্তব্যের সঙ্গে কোর’আনের অমিল দেখ তাহলে কোর’আনকে গ্রহণ করবে।” আর যে বিষয় কোর’আনে আছে সে বিষয়ে ইজমা-কিয়াস করাই ধৃষ্টতা।
হিন্দুদের বিরুদ্ধে এভাবেই কোনো কারণ ছাড়াই চালানো হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি
এভাবেই অপছন্দের পাত্রকে কাফের ফতোয়া দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার আহ্বান করা হয়।
মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিনা?
বিশিষ্ট ইসলামি শরিয়াহ গবেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান মাহমুদের “শরিয়ত কী বলে – আমরা কী করি” গ্রন্থে তার একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করছি। তিনি লিখেছেন, “ইসলাম কোন ইঁদুর-মারা কল নয় যে এতে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরুনো যাবে না।”
মুরতাদ তাকে বলা হয় যে আগে মুসলমান ছিল কিন্তু এখন ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে। মুরতাদ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘রাদ্’। এর সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলো যেমন ইরতাদা, রিদ্দা এবং মুরতাদ সবই হল স্বকর্ম। নিজে থেকে না বললে বা না করলে বাইরে থেকে কেউ কাউকে স্বকর্ম করাতে পারে না। যেমন আত্মহত্যা। আত্মহত্যা যে করে সে-ই করতে পারে, অন্যেরা খুন করতে পারে কিন্তু কাউকে আত্মহত্যা করতে পারে না। ঠিক তেমনি মুরতাদও নিজে ঘোষণা করতে হয়, অন্য কেউ করিয়ে দিতে পারে না। মুরতাদের ওপরে কোরানে কোথাও কোন পার্থিব দণ্ড নেই বরং এর ভেতরে মানুষের নাক গলানো নিষেধ করা আছে। আল্লাহ বলেছেন তিনি নিজেই তাকে শাস্তি দেবেন। ইউরোপিয়ান ফতোয়া ও গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য বিশ্ব-বিখ্যাত শরিয়া সমর্থক ড. জামাল বাদাওয়ীও এ কথাটি বলেছেন যে, “কোরা’আনের কোন আয়াতেই মুরতাদের দুনিয়ায় শাস্তির বিধান নাই। কোর’আন বলে, এই শাস্তি শুধুমাত্র পরকালেই হইবে” (ফতোয়া কাউন্সিলের ওয়েবসাইট)।
অনেকে মনে করেন মুরতাদদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা বিধিসম্মত!
এর পক্ষে সাধারণত সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতটি উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো আগুনের অধিবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।” স্পষ্টতই এখানে মুরতাদকে আখেরাতে জাহান্নামবাসী হওয়ার কথা বলা হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারার পার্থিব দণ্ডবিধি প্রদান করা হয় নি। জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার তো প্রশ্নই আসে না। রসুলাল্লাহ কোনো মানুষ, জীবজন্তু বা কোনো ফলদ গাছপালাকে আগুনে পোড়াতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আগুন দ্বারা কেবল আল্লাহই শাস্তি দিবেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারো আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই” (বোখারি ও আবু দাউদ)।
আল্লাহ বলছেন, “যারা একবার বিশ্বাস স্থাপন করার পর (মুসলমান হয়ে) আবার কাফের হয়ে গেছে, আবার মুসলমান হয়েছে এবং আবার কাফের হয়েছে এবং কুফরিতেই উন্নতিলাভ করেছে, আল্লাহ তাদেরকে না কখনও ক্ষমা করবেন, না পথ দেখাবেন।” (সুরা নিসা ১৩৭) অর্থাৎ কোর’আন মুরতাদকে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। তাকে খুন করলে ‘আবার মুসলমান’ হবার সুযোগ সে পাবে না, সেই খুন সরাসরি কোর’আন লঙ্ঘন হয়ে যাবে। রসুলাল্লাহর ওহি-লেখক আবদুল্লাহ বিন সা’আদ-ও মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। এ হেন মহা-মুরতাদকেও রসুলাল্লাহ মৃত্যুদণ্ড দেন নি (ইবনে হিশাম-ইসহাক পৃঃ ৫৫০) বরং ওসমান (রা.) পরে তাকে মিশরের গভর্নর করেছিলেন।
ইসলামের একটি মূল নীতি হচ্ছে, এই দীনে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই (সুরা বাকারা ২৫৬)। পবিত্র কোর’আনে কিছু অপরাধের দণ্ডবিধি আছে কিন্তু তাই বলে কোর’আন শুধুমাত্র দণ্ডবিধির বই নয়, এতে বহু কিছু আছে। আল্লাহ একে উপদেশগ্রন্থ বলেছেন। এখানে কিছু চিরন্তন মূল্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে যা গ্রহণ করলে মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে উন্নত হবে এবং তাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই শান্তিই হচ্ছে ‘ইসলাম’। জোর করে কোনো ধর্মবিশ্বাস কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের নীতি নয়, হত্যা করা দূরে থাক। আল্লাহ বলছেন, “সত্য তোমাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। অতঃপর যার ইচ্ছা তা গ্রহণ করুক, যার ইচ্ছা তা প্রত্যাখ্যান করুক (সুরা কাহাফ ২৯)।” তিনি বহুবার তাঁর রসুলকে বলেছেন, “তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তি করবে ঈমান আনিবার জন্য? (সুরা ইউনুস ৯৯) যে লোক বিমুখ হলো, আমি তোমাকে তাদের জন্য দারোগা নিযুক্ত করি নি। (সুরা নিসা ৮০)

মুরতাদ-হত্যার বিরুদ্ধে কোর’আনের সবচেয়ে স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুরা ইমরান-এর ৮৬ নম্বর আয়াতে। হারিস নামে এক মুসলমান মুরতাদ হলে তার সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল এ আয়াত; “কেমন করে আল্লাহ এমন জাতিকে হেদায়েত দেবেন যারা ঈমান আনার পর ও রসুলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেবার পর ও তাদের কাছে প্রমাণ আসার পর কাফের হয়েছে?” রসুলাল্লাহ তাকে মৃত্যুদণ্ড কেন, কোন শাস্তিই দেন নি (সিরাত ইবনে হিশাম, সিরাত ইবনে ইসহাক)।

ফতোয়ার বইয়ে থাকা আরেকটি ভয়ানক আইন হল, মুরতাদকে যে কেউ রাস্তাঘাটে খুন করতে পারে, তাতে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না [বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খ- (ইফাবা), ধারা ৭২]। অর্থাৎ মুফতি পরিচয় নিয়ে যে কেউ কোনো ব্যক্তিকে মুরতাদ ঘোষণা করলে তাকে অপর কোনো ব্যক্তি ঈমানী চেতনা থেকে রাস্তাঘাটে খুন করে ফেলতে পারে। মুসলিম-বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং শরিয়া আদালতে খুনীর শাস্তি হয় নি।
ফতোয়ার বইয়ে থাকা আরেকটি ভয়ানক আইন হল, “মুরতাদকে যে কেউ রাস্তাঘাটে খুন করতে পারে, তাতে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না।” কে মুরতাদ সে সিদ্ধান্তও তাদের, বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও তাদেরই।
পবিত্র কোর’আনে অত্যাচারী শাসকের দ্বারা নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে রক্ষা করার লক্ষ্যে যে পবিত্র ও ন্যায়যুদ্ধের হুকুম স্রষ্টা দিয়েছেন সেটা বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্র, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের যুদ্ধ ঘোষণা করার অধিকারই ইসলামে নেই। সুতরাং যুদ্ধের আয়াত দেখিয়ে কোনো সংগঠন বা দলের উদ্যোগে নরহত্যা, কথিত কাফের হত্যা, মুরতাদ হত্যা, বিধর্মী হত্যা, ইসলামবিদ্বেষী হত্যা সম্পূর্ণ অ-ইসলামিক এবং সেটা সন্ত্রাস ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু তাহলে যে লোক মুসলমান থাকতে চায় না তাকে খুন করার ভয় দেখিয়ে মুসলমান রাখা সরাসরি কোর’আন-লঙ্ঘন ও রসুলাল্লাহর অবমাননা নয়?
মুরতাদ হত্যার পক্ষে কোর’আনের পাতায় ও রসুলের জীবনের ঘটনাবলীতে কোনো প্রমাণ খুঁজে না পেয়ে আঁকড়ে ধরা হয়েছে কিছু হাদীসকে। যেমন রসুল বলেছেন, “যে ব্যক্তি ধর্মত্যাগ করে তাকে হত্যা কর” (বোখারী)। এ হাদীসটি নিয়ে মওলানাদের মধ্যেই মহা-বিতর্ক আছে কারণ কোর’আনে কিছু অপরাধের জন্য বেত্রাঘাতের দণ্ড পর্যন্ত উল্লেখ থাকতে পারে, আর যে অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দণ্ড (Capital Punishment) দেওয়া হবে সেটার কোনো উল্লেখই থাকবে না, রসুলাল্লাহর জীবনে তার একটাও দৃষ্টান্ত থাকবে না এটা কীভাবে হতে পারে? বরং কোর’আনে তো উল্টো কথাই আছে যা উপরে বলে এসেছি।
তারা যখন কোন মন্দ কাজ করে, তখন বলে আমরা বাপ–দাদাকে এমনি করতে দেখেছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জান না। (সুরা আরাফ ২৮)
রসুলাল্লাহর (দ.) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনী ইবনে হিশাম/ইসহাকে আমরা চারজন মুরতাদের দলিল পাই – উবায়রাক, হারিস, নবীজীর ওহি লেখক ইবনে সা’দ এবং উবায়দুল্লাহ (পৃষ্ঠা ৩৮৪, ৫২৭ ও ৫৫০)। এদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড কেন, কোনো শাস্তিই দেন নি রসুল। তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন, তবু সর্বদা মেনে চলেছেন – লা-ইকরাহা ফিদ্দিন, দীনে কোনো জবরদস্তি নেই। তবে যারা বার বার রসুলাল্লাহর ক্ষমা লাভ করেও বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র করেছে, বিদ্বেষ ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে তারা স্বভাবতই দণ্ডযোগ্য অপরাধী, যে কোনো যুগে যে কোনো রাষ্ট্রেই তারা দণ্ডপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু যারা বিদ্রোহ করে নি, কেবল ইসলাম ত্যাগ করেছে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার একটি দৃষ্টান্তও রসুলাল্লাহর পবিত্র জীবনীতে কেউ দেখাতে পারবে না।
একটি ঘটনা লক্ষ্য করুন। জাবির বিন আবদুল্লাহ বলেন, এক বেদুইন আল্লাহ’র রসুলের কাছে বায়াত গ্রহণ করল। পরে মদিনায় তার জ্বর হলে সে আল্লাহ’র রসুলের নিকট এসে বলল ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরিয়ে দিন।’ রসুল সম্মত হলেন না। তারপর সে আবার এসে বলল, ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরিয়ে দিন।’ রসুল সম্মত হলেন না। তারপর সে আবার এসে বলিল ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরিয়ে দিন।’ রসুল সম্মত হলেন না। তারপর সে মদিনা ছেড়েই চলে গেল। এতে আল্লাহ’র রসুল বলিলেন, “মদিনা একটি উনুনের মতো, তা ভেজালকে বাহির করে দেয় এবং ভালোকে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল করে।” (বোখারী- ৯ম খ- হাদিস ৩১৮)। অর্থাৎ ঐ লোকটি সত্যিকারভাবে মুমিন হয় নি, তার ভেতরে দ্বিধা ও সন্দেহ ছিল। তাই সে যখন ঈমান ত্যাগ করে চলে গেল রসুলাল্লাহ তাকে শাস্তি প্রদান তো দূরের কথা তার পথরোধও করলেন না।
অনেকে রসুলাল্লাহর এন্তেকালের পর আবু বকর (রা.) যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন সেটাকে মুরতাদ হত্যার দলিল হিসাবে দাঁড় করাতে চান। বলা হয় দূরের কিছু গোত্র মুরতাদ হয়েছিল এবং আবু বকর (রা.) সৈন্য পাঠিয়ে তাদের পরাজিত করেছেন। বিষয়টি এত সরল নয়, এর মধ্যে কথা আছে। তারা বলেন, আবু বকর (রা.) নাকি সিপাহসালারকে চিঠি দিয়েছিলেন যে, ‘ইসলাম কবুল না করলে কাউকে জীবন্ত ছাড়বে না, আগুন জ্বালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে এবং তাদের নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে।’ কিন্তু এমন চিঠি আবু বকর (রা.) কী করে লিখতে পারেন? তিনি কি কোর’আন লঙ্ঘন করলেন? কোথায় গেল নবীজীর সেই যুদ্ধনীতি, “নারী ও শিশুদের হত্যা করবে না?” (ইবনে মাজাহ ৪র্থ খ- ২৮৪১, ২৮৪২)?
এভাবেই কিছু কিছু ফতোয়াবাজ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে পরিচালিত যুদ্ধকে ধর্মত্যাগীদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার যুদ্ধ বলে ব্যাখ্যা দিয়ে রসুলাল্লাহর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সাহাবি আবু বকরের (রা.) উপর অপবাদ আরোপ করেছেন। তারা আবু বকরকে (রা.) একেবারে হালাকু খান বানিয়ে ছেড়েছেন। মূলত নবগঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের সার্ভভৌমত্ব ধ্বংস করার জন্য বিদ্রোহীরা ষড়যন্ত্র করছিল এবং সেনা সমাবেশ করেছিল। এজন্য আবু বকর (আ.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেছেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্রোহীদের দমন করার এই অভিযান প্রেরণ করাটা তার কেবল অধিকার নয়, এটা তার দায়িত্ব। কিন্তু একজন মুফতি-মওলানা ব্যক্তিগতভাবে এই অভিযান প্রেরণের অধিকারই রাখেন না। কেউ যদি এটা করেন তাহলে তারা প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহী তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতেও কোর’আন ও রসুলের কর্মপদ্ধতি তথা সুন্নার খেলাফ করলেন।
কলেমার মর্যাদা রসুলাল্লাহ কীভাবে রক্ষা করেছেন তা বোঝার জন্য এই ঘটনাটির প্রতিটি শব্দ খেয়াল করে পড়ুন: “উসামা বিন জায়েদ (রা.) বলেছেন, ‘যখন আমি ও এক আনসার তাহাকে (মিরদাস বিন নাহিক নামে এক অমুসলিমকে যার গোত্রের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছিল) আমাদের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে পাকড়াও করলাম তখন সে কলেমা উচ্চারণ করল। কিন্তু আমরা থামলাম না এবং তাহাকে হত্যা করলাম।’ রসুলের নিকট এসে আমরা এই ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, ‘কলেমার দায় থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে, উসামা?’ আমি বলিলাম, ‘লোকটি শুধু মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য কলেমা উচ্চারণ করেছে।’ রসুলাল্লাহ প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি তার বক্ষ চিরে দেখেছিলে? তুমি তার বক্ষ চিরে দেখলে না কেন?’ তিনি প্রশ্নটি করতেই থাকলেন এবং করতেই থাকিলেন। তখন আমি ক্ষমা প্রার্থনা করলাম এবং বললাম আমি আর কখনোই তাকে খুন করিব না যে কলেমা উচ্চারণ করেছে। তিনি বললেন, ‘আমার (মৃত্যুর) পরেও তুমি এইকথা বলবে তো?’ আমি বললাম, ‘বলব’।”(সিরাত ইবনে হিশাম, ইবনে ইসহাক, মুসনাদ- ইমাম হাম্বল)। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ মুরতাদ-ঘোষণার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের গ্যারান্টি চেয়েছেন। সে গ্যারান্টি দিতে হবে প্রতিটি মুসলমানকে। কলেমার দায় বড় দায়, কলেমার অবমাননা ইসলামের অবমাননা!
প্রশ্ন উত্তর

যিনি নিজেকে সর্ব শ্রেষ্ট সর্ব শক্তিমান বলে দাবি করে তাকে কেন ক্ষুদ্র মানুষের বিরুদ্ধে জয় পেতে হলে যুদ্ধ করতে হয়?


লক্ষ্য করুন মানুষ সৃষ্টির আগে মালায়েকদের সাথে (ফেরেশতা) আল্লাহ্‌ কি কথোপকথন করলেন, এখান থেকে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বুঝা যায়।

আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না। (2:30)

আর আল্লাহ তা’আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক। (2:31)

তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদিগকে শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। (2:32)

তিনি বললেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি? এবং সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর! (2:33)

এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। (2:34)

মানুষ সৃষ্টি কোরা হয়েছে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে [যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়। (67:2)], যদি সব আল্লাহ্‌ ই কোরে ফেলেন তবে আমাদের যাচাই হবে কি করে?

 

আপনি দেখুন ইবলিসের সাথে আল্লাহ্‌ এর চ্যালেঞ্জটাঃ

আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব, তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বলছি-আদমকে সেজদা কর তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলীস সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। (7:11)

আল্লাহ বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল? সে বললঃ আমি তার চাইতে শ্রেষ্ট। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা। (7:12)

বললেন তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নাই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত। (7:13)

সে বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। (7:14)

আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। (15)

সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো।(7:16)

এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। (7:17)

আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথেচলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব। (7:18)

এই চ্যালেঞ্জের কারণেই আল্লাহ্‌ চাইলেই সর্বশক্তিমান হয়েও ক্ষুদ্র মানুষকে শায়েস্তা করতে আল্লাহ্‌ এর পক্ষের লোকদের আদেশ করেছেন। যদি নিজে নিজেই হও বলেই করে ফেলতেন তবে ইবলিশের সাথে চ্যালেঞ্জ হয়না, কারণ ফাঁকা মাঠে গোল কে গোল বলা যায়না।

যে কেউ ইসলাম না মানতে পারে, এতে কাউকে হত্যার নির্দেষ আল্লাহ্‌ দেননি, বরং যারা মুসলেমদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন যেটা বৈধ আপনাদের এই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার মানদণ্ডেও। সেলফ ডিফেন্স পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের সংবিধানেই বৈধ। অতএব আপনার আল্লাহ্‌ এর বিরোদ্ধে এই অভিযোগ অবান্তর। আমি আবারও বলছি, আপনি ভুল করে আল্লাহ্‌ কে অপবাদ দিচ্ছেন, নিরপরাধ লোককে হত্যা কোরাকে আল্লাহ্‌ নিষেধ করেছেন, এমনকি গোটা মানব জাতিকে হত্যার সমান বলেছেন।

এ কারণেই আমি বনী-ইসলাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবাপৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন। বস্তুতঃ এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে। (5:32)

চিন্তা করুন কতো গভীর ভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা কোরতে আল্লাহ্‌ নিষেধ করেছেন!

একটা আয়াত দিচ্ছি বুঝার জন্যঃ

ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। (60:8)

আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

প্রশ্ন উত্তর

অভিযোগঃ বোরকা পড়তে বাধ্য করা হবে সবাই কে। বিশেষ সরিয়াহ পুলিশ থাকবে এগুলা তদারকিতে।


উত্তরঃ আপনি ভুল বলেছেন। আপনি তথাকথিত সরিয়ার কথা বলেছেন যা আল্লাহ্‌ এর হুকুমের ধার না ধেরে নানান শাইখদের ইচ্ছামতো তৈরি হওয়া একটা আইনকে দিয়ে ইসলামকে যাচাই করছেন। সরিয়া আইন কেন ইসলাম নয় এর বিস্তারিত জানতে পারবেন হাসান মাহমুদ এর লেখা বই সরিয়া কি বলে আমরা কি করি? বইটিতে। এখান থেকে ডাউনলোড করে নিন

হ্যাঁ, কাউকে অশ্লীল চলতে দেয়া হবেনা কিন্তু জোর করে বোরকা চাপিয়ে দেয়া হবেনা। আর আপনি যা দেখে বেঁড়ে উঠেছেন তা ইসলামের প্রকৃত পর্দা নয়। ইসলামের প্রকৃত পর্দা সম্পর্কে জানুন সুরা হাযাব এর ৫৯ নম্বর আয়াত থেকে >> নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।

নিচে একটা ছবি দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি প্রকৃত পর্দা কেমন হবেঃ

প্রশ্ন উত্তর

আপত্তিঃ পুরুষ দের জন্য সুখবর, ৪ টা পর্যন্ত বিবাহ করা জায়েজ হবে এবং ১৮ বছরের নিয়ম উঠে যাবে সুন্নত অনুজায়ি।


পুরুষের ৪ বিবাহ বৈধ হবার ব্যাপারেঃ 

পুরুষের ৪ টা বিবাহ করা জায়েজ মানে এই নয় ফরজ, বরং এটা শর্তসাপেক্ষে জায়েজ। শর্তগুলো আপনাকে দেখতে হবে কি কি আদেশ আছে এই বৈধ হওয়ার জন্য। সুরা আন-নিসা এর ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতীম মেয়েদের হক যথাথভাবে পুরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।

মানুষের অবৈধ সম্পর্ক্য থেকে বাঁচিয়ে রাখতে ও অসহায় এর সহায় এর ব্যাবস্থা সরূপ সর্বোচ্চ ৪ টা বিয়ে পর্যন্ত বৈধ করা হয়েছে। খেয়াল করে দেখুন শর্তগুলো, আপনার জানা কোন এতিম থাকলে তাঁর হক পূরণে সমস্যা হবে মনে করে থাকলে বিয়ে করে নিতে পারবেন। তার আগে দেখুন পুরুষের বিয়ের যোগ্যতা কি, সাবালক হওয়া, ভরন-পোষনে সামর্থবান হওয়া ও শারীরিক সক্ষমতা থাকা, আর বলেছেন ইনসাফ করতে মানে সকল স্ত্রীর প্রতি ন্যায় আচরণ করতে, আনহলে একটি বিয়ের কথা বলেছেন। আপনি যদি একটা স্ত্রীকে এই শর্ত পূরণ করে বিয়ে করতে পারেন তবে একাধিক এ সমস্যা কোথায়? একাধিক বিয়েতে তো নারীদের সামাজিকভাবে নিরাপত্তা বাড়ল বরং। সবথেকে বড় কথা সামর্থবান না হলে একটাও না! সুরা নূর এর আয়াত ৩৩ দেখুন।

আল্লাহ্‌ কেন ৪ টা পর্যন্ত বিয়ে বৈধ করেছেন? ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন যখন প্রচুর যুদ্ধ হচ্ছিলো সেই যুদ্ধে পুরুষেরা শহিদ/নিহত হচ্ছিলো, এতে নারীরা অভিবাবকহীন হয়ে পড়ছিল তাই তাদের অভিবাবক এর ব্যাবস্থা করলেন চমৎকার পদ্ধতির মাধ্যমে। যুদ্ধ পরবর্তি একটা নারীর কাছে সহায়হীন রাস্তায় পড়ে থাকার চেয়ে একজন স্বামী পাওয়া কতোটুকু রক্ষা একবার গভীর চিন্তা করে দেখুন! যুদ্ধের সময় নারীর সংখ্যা বেশি হয়ে যায় পুরুষের বিপরীতে এতে একাধিক বিবাহ প্রাক্রিতিকভাবে দরকার হয়ে পরে। আবার যখন যুদ্ধ থাকেনা এমনিতেই পুরুষ মহিলার অনুপাত কাছাকাছি চলে আসে প্রাকৃতিক ভাবেই, তখন সাধারণত এক বিয়ে করলেই সামাজিক স্থিরতা বজায় থাকে। সামাজিক স্থিরতার জন্য এটা একান্তই দরকার, নাহলে সমাজে অবৈধ সম্পর্ক বেঁড়ে যাবে।

 

বিয়ের বাধ্যতামূলক ১৮ বছর হওয়ার ব্যাপারেঃ 

পুরুষের বিয়ে করতে ১৮ বছর হওয়া লাগবে কেন? শারীরিক ভাবে সক্ষম হলে আর বাকী শর্ত পূরণ করতে পারলে বিয়ে করতে দোষ কোথায়? আপনাকে বুঝতে হবে এই ১৮ বছরের বিধান দিয়েছে শুধু শারীর সক্ষমতা যেন তৈরি হয় সেই জন্য। কারও যদি এর আগে তৈরি হয় তাকে আটকে রাখা কি অমানবিক নয়? কোন আইন উত্তম আবার ভাবুন। ইসলাম শুধু সমস্যার বিপরীতে দ্বায়সারা আইন ই দেয়নি বরং সমস্যার সম্পূর্ন সমাধান দিয়েছেন এর মাধ্যমে। ১৮ বছরের আগের অবৈধ সম্পর্ক বন্ধ করার ব্যাবস্থা করে রেখেছেন।

প্রশ্ন উত্তর

সমস্যাঃ ইসলামিক পরিবারে যে জন্ম গ্রহণ করে বিধর্মী বা নাস্তিক হয়ে গেলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড (তসলিমা নাসরিন , হুমায়ুন আজাদ , উদাহরণ)।


সমাধানঃ  বর্তমানে আমাদের দেশে একমাস দেড়মাস অন্তর একজন করে ব্লগার হত্যা করা একটি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই দায় স্বীকার করেছে কোনো না কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতে নাতে ধরাও পড়েছে। জঙ্গিরা আল্লাহ ও রসুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীদেরকে হত্যা করাকে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করেন। কিন্তু আসলে কি এমন নির্দেশ আল্লাহ বা রসুল দিয়েছেন? আপনি যেই উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলো বিকৃত ইসলামের ফসল! আসুন দেখা যাক এ বিষয়ে আল্লাহর কী সিদ্ধান্ত। আল্লাহ বলেনঃ

1. লোকেরা যেসব কথাবার্তা রচনা করে বেড়াচ্ছে, সে জন্য তুমি ধৈর্যধারণ করো এবং সৌজন্য রক্ষা করে তাদের থেকে সম্পর্কহীন হয়ে যাও। বিত্ত-বৈভবের অধিকারী মিথ্যারোপকারীদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে কিছু অবকাশ দাও। নিশ্চয় আমার কাছে আছে শিকল ও অগ্নিকুণ্ড। (সুরা মুযযাম্মিল: ১০-১২)

সুতরাং বোঝা গেল আল্লাহ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ধৈর্য ধারণ করতে হুকুম দিচ্ছেন এবং তাদেরকে কোনোরূপ পার্থিব শাস্তি না দিয়ে আল্লাহর হাতে সমর্পণ করতে বলছেন। আল্লাহই তাদেরকে জাহান্নামের নিক্ষেপ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ আরো বলেন,

2. তোমরা যেখানেই আল্লাহর আয়াতের বিরুদ্ধে কুফরীর কথা বলতে এবং ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে শুনবে, সেখানে তোমরা আদৌ বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কোনো কথায় লিপ্ত হয়। তোমরা যদি তা করো, তবে তোমারাও তাদেরই মতো হবে। (সুরা আন নিসা: ১৪০)

3.তুমি যখন দেখবে, লোকেরা আমার আয়াতসমূহের দোষ সন্ধান করছে, তখন তাদের নিকট থেকে সরে যাও। (সুরা আনয়াম: ৬৮)

4. আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয়: তোমাদের প্রতি সালাম। (সুরা আল ফুরকান: ৬৩)

5. জাহেল লোকদের থেকে বিরত থাক। (সুরা আল আরাফ: ১৯৯)

সুতরাং যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী আল্লাহ মো’মেনদেরকে বলছেন তাদের সঙ্গে কোনোরূপ বিতর্ক বা সংঘাতে না জড়াতে। উপরন্তু তাদেরকে সালাম দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে আদেশ করেছেন।

আল্লাহ ও রসুলের বিরুদ্ধে যারা ভয়াবহ অশ্লীল বক্তব্যসম্বলিত কার্টুন চলচ্চিত্র, সাহিত্য রচনা করে তাদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে ক্ষোভ সঞ্চারিত হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তারা যেন কোনো ভুল কাজ না করে ফেলেন বা অতিমাত্রায় সন্তপ্ত না হন মোমেনদেরকে আল্লাহ সেজন্য সান্ত্বনা দান করেছেন। তিনি বলেন,

৬. এ লোকেরা যে সব কথা বলে তা যেন তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও দুঃখিত না করে। তাদের প্রকাশ্য ও গোপন সব কথাই আমরা জানি। (সুরা ইয়াসীন: ৭৬)

৭. এ লোকদের কার্যকলাপ তুমি দুঃখিত হয়ো না আর তাদের অবলম্বিত ষড়যন্ত্রের দরুন হৃদয়কে ভারাক্রন্ত করো না। (সুরা আন নাহল: ১২৭)

তাহলে অপপ্রচারকারীদের ব্যাপারে মো’মেনদের করণীয় কী হওয়া উচিত? সেটা হচ্ছে আল্লাহ কী বলেছেন আর সে মোতাবেক আল্লাহর রসুল কী করেছেন তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

আল্লাহর রসুলকে আজ গালি দেওয়া হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিন্তু রসুল যখন মক্কায় ছিলেন তখন তো তাঁর সামনেই তাঁকে অকথ্যভাষায় গালাগালি করা হয়েছে। তাঁকে গণক, পাগল, জাদুকর, মিথুক বলা হয়েছে, তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতিত লাঞ্ছিতও করা হয়েছে। রসুলাল্লাহ কি পারতেন না তাঁর অনুগত আসহাবদের হুকুম দিয়ে আবু জেহেলকে কুপিয়ে হত্যা করাতে?

অবশ্যই পারতেন কিন্তু আল্লাহর হুকুম তা ছিল না। তিনি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক মানুষের সামনে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য প্রচার করে গেছেন। একটা সময় এসেছে যখন এককালের চরম নির্যাতনকারীর মানসিক পরিবর্তন এসেছে, তারা ইসলাম গ্রহণ করে রসুলাল্লাহর শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। একেই বলে আদর্শিক লড়াই, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব। আল্লাহ বলেছেন,

৮. হে শ্রোতা! মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করো! তখনই ঐ ব্যক্তি সে, এমন হয়ে যাবে যেমন অন্তরঙ্গ বন্ধু। (সুরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াত-৩৪)

৯. নবী ও রসুলগণ প্রত্যেকে তাঁদের স্ব স্ব সম্প্রদায়কে বলেছেন, আমাদের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে সংবাদ পৌঁছে দেয়া (সুরা ইয়াসীন ১৭)।

 

এই লেখার বেশিরভাগ নেয়া হয়েছে এখান থেকে

প্রশ্ন উত্তর

প্রতিবন্ধকতাঃ সরকারী বেসরকারী সব জায়গায় নামাজ পড়ার “ব্রেক” থাকেবে মিনিমাম আধা ঘন্টা তো লাগবে প্রতিবার।


সমাধানঃ রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম হলে নামাজ (সালাহ) কায়েম হবে, আল্লাহ্‌ সালাহ কায়েম করতে বলেছেন। কায়েম হোল এমন কিছু যা অনেক গভীরে প্রথিত হয়ে যায়, যেমন খুঁটি গাড়া হয়। সালাহ যখন রাষ্ট্রে কায়েম হবে তখন রাষ্ট্রের বিধান থাকবে সালাহ এর সময় হলে সকল কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে সালাহ কায়েম করতে হবে, সেক্ষেত্রে কোন সমস্যাই নাই কারণ এটা ঐচ্ছিক না বাধ্যতামূলক হবে। তখন আপনি সালাহ না কায়েম করলেও কোন ক্ষতিও হবেনা, কারণ সরকারি বেসরকারি সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এমন নয় যে এক অফিসে কাজ হবে আর আপনি আটকে আছেন নামাজের বিরতির জন্য। সালাহ শেষে আবার সবাই কাজ শুরু করবে, এটা হবে এক যোগে আপনার এলাকার সকল যায়গায়। তাই আপনার এতে কোন ক্ষতিই হবে না।

৪ রাকাত সালাহ কায়েমে করতেউজু সহ বড় জোর ১৫-২০ মিনিট লাগবে সময়। এখনকার অফিসেও ব্রেক নেয় খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, এখন সমস্যা না হলে তখন সমস্যা হবে কেন? ধরেন অফিস সময় শুরু হোল সকাল ৮ টা থেকে। ১ টার দিকে বিরতিতে যোহরের সালাহ ও খাবারের বিরতি হবে ১ ঘণ্টা, আবার দুইটার সময় কাজ শুরু হবে। আবার আসরের সালাহ এর জন্য ৪ টার দিকে ৩০ মিনিটের বিরতি দেয়া হবে, অফিস শেষ হবে ৫ টা ৩০ মিনিট এ। সমস্যা কোথায়? খেয়াল রাখবেন মুসলেম গোটা জাতিই অত্যন্ত ডায়নামিক, তাঁরা এটা ম্যানেজ করতে পারবে যেমন পারে সেনাবাহিনী।

এবার কিছুটা ধারণা দেই বেসামরিক জীবনযাপনের। সালাহ যেমন কায়েম করতে হয় বিক্রেতার তেমনই ক্রেতারও কারণ দুই পক্ষের জন্যই ফরদ। যদি আপনি বিক্রেতা হোন আর দেখেন সকল ক্রেতা সালাহ কায়েম করতে গেছে তাহলে আপনার দোকান খোলা রাখার কোন মানে আছে? আর যদি সকল বিক্রেতাই সালাহ এর সময় দোকান বন্ধ করে সালাহ কায়েমে মসজিদে চলে যায় আপনি ক্রেতা হয়ে ওই সময় কিছু কিনতে পারবেন? পারবেন না, তাই এই পদ্ধতিতে যখন সবাই ধাতস্থ হয়ে উঠবে এটা কোন সমস্যা ই মনে হবেনা। বরং এই পদ্ধতির সুবিধা ব্যাপক। কাজের চাপ থেকে একটু বিরতি হবে, মানুষ স্রষ্টার কাছে হাজিরা দিয়ে মনের প্রশান্তি পাবে, ঝামেলার বিচার দিয়ে বিচার পাবে সেই মসজিদ থেকেই (শুক্র বারে)। মসজিদের ইমাম হবে বিচারক আর বড় বিচার পাঠিয়ে দিবে কাজির দরবারে (অনেকটা কোর্ট এর মতো)।

বোঝা গেলো সালাহ এর বিরতি কোন সমস্যাই হবেনা।

প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্নঃ সকল টিভি/রেডিও চ্যানেল বন্ধ ঘোষণা করা হবে, রাষ্ট্রীয় ইসলামিক টিভি/রেডিও ছাড়া , এবং গান বাজনা , নাটক সিনেমা, ইত্যাদি শয়তানের কাজ কর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে। ব্যান্ড দল গঠন করা নিষিদ্ধ , কারণ গান বাজনা শয়তান এর আজান এবং হৃদয় কে কুফুরীর দিকে ঠেলে দেয়।


উত্তরঃ আপনাকে প্রথমেই জানতে হবে ১৪০০ বছরে ইসলামের ভিতর নানান বিকৃতি এসেছে। মোল্লা শ্রেণীর চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলে কিছু কম গুরুত্বপূর্ন বিষয় হয়ে গেছে মহা গরুত্বপূর্ন বিষয় আবার মহা গুরুত্বপূর্ন বিষয় হয়ে গেছে তুচ্ছ বিষয় এমনকি হারিয়েই গেছে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে! এরকম চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলেই আঙ্গুল ব্যাথায় পুরো হাত কাঁটা, মাথা ব্যাথায় মাথাই কেটে ফেলার ব্যাপার হয়েছে এই গত ১৪০০ বছরে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে মুসলেমরা প্রকৃত ইসলাম চর্চা করছেনা, বরং মুল্লাদের বানানো ইসলাম পালন করছে যা প্রকৃত ইসলাম থেকে শুধু যে দূরে তা নয় একদম বিপরীতমুখী।

প্রকৃত ইসলামে গান নিষিদ্ধ নয়, বাজনা নিষিদ্ধ নয় অতএব ব্যান্ড গঠনে কোন বাঁধা নাই, রেডিও টেলিভিশন নিষিদ্ধ নয়, নাটক সিনেমা নিষিদ্ধ নয় এগুলোকে শয়তানের কাজ গণ্য করা হয়না। কিন্তু নিষেধ হচ্ছে অশ্লীলতা করা, শেরক-কুফর করা। উপরে উল্লেখিত ব্যাপারে যদি শেরক-কুফর না করেন আর অশ্লীলতা না করেন তবে সবগুলোই বৈধ কাজ। প্রকৃত ইসলামের সময় গান ছিলো তবে অশ্লীল গান নিষেধ ছিলো। বাদ্য যন্ত্র দিয়ে গান গাওয়ার নজির আছে। এমনকি মোহাম্মদ (সঃ) কে মদিনা বাসি গানে গানে বরণ করে নিয়েছিলো। গান ও বাদ্য যন্ত্র নিয়ে ফেইসবুকে একটা নোট পড়তে পারেন এখান থেকে

আপনি নিজেও তো অশ্লীলতার বিপক্ষে বলবেন, বলবেন না? অতএব ইসলামিক শাসন কায়েমে এগুলো কোন ভীতির কারণ নয়। ইসলাম সেইগুলোই নিষেধ করে যা মানব জাতির জন্য ক্ষতিকর, সমাজের জন্য ক্ষতিকর, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।

প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্নঃ “বিধর্মী” দের জিজিয়া কর দিতে হবে, রাষ্ট্রের অনন্য ট্যাক্স এর উপর বাড়তি কর হিসাবে। যা তাদের কে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিনিত করবে। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে মুসলিম দের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে ব্যবসা/চাকুরী তে।


জিজিয়া এর উত্তরঃ 

ইসলামি শাসন ব্যাবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হলে এই জিজিয়া দিতে হবে শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক (যুদ্ধক্ষম) মানুষদের, যারা মুসলেম বাহিনীতে থেকে যুদ্ধ করবে তাঁরা এই করের বাইরে থাকবে। তাই এটা কোন বড় বাঁধা নয়, আপনি চাইলেই এই কর এরাতে পারেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় অংশগ্রহণ করে। আপনি যদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার দেশে থাকেন আর সেই দেশ শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে আপনার উচিৎ হবে রাষ্ট্রে রক্ষায় অংশগ্রহণ করা, এটা অনেকটা বাধ্যতামূলক এর মতো যেকোন শাসন ব্যাবস্থায়।

এই কর কেন নিতে হবে? আপনাকে আপনার পরিবারকে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিচ্ছে, আপনার নিজ ধর্ম কর্ম করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে ও পূর্ন নিরাপত্তা দিচ্ছে সামরিক বাহিনী দ্বারা আর আপনি তাঁর জন্য কর দিবেন না?। এই কথা অন্তত পৃথিবীর কোন দেশে থেকে বলতে পারবেন না। রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার ফলে আপনার দাওিত্ব আছে, গণতান্ত্রিক দেশে যেমন কর পরিশোধ করতে হয় তেমনই ইসলামিক রাষ্ট্রেও আপনাকে কর দিতে হবে এটা স্বাভাবিক। ইসলাম আপনার উপর জুলুম (জোর করা) করছেনা বরং আপনাকে অপশন দিয়েছে যেন আপনি অভিযোগ না করতে পারেন যে আপনাকে দিয়ে জোর করে যুদ্ধ করিয়েছে, আপনাকে জোর করে যুদ্ধে নিয়ে গেছে।

কিছু ব্যাপার সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা রাখতে হবে। ইসলাম যখন শাসন করে তখন গোটা জাতি ই একটা সামরিক বাহিনী হিসেবে কাজ করে। এটা আপনি দেখবেন দিনের পাঁচ ওয়াক্তে, ও ইতিহাস ঘাঁটলে। যেহেতু ইসলামিক শাসন ব্যাবস্থায় সবাই সামরিক (প্রাপ্ত বয়স্ক) সেহেতু যুদ্ধ যদি না করেন আপনাকে অতিরিক্ত কর (জিজিয়া) দিতে হবে, এটা একটা ইসলামের শাসনাধীন রাষ্ট্রের আইন, যেমন একেক দেশে একেক ধরণের কর দিতে হয়। কোন দেশে ১৫% কোন দেশে ৪৯%, করের পরিমাণ গণতান্ত্রিক সব দেশেও এক নয়। আপনাকে রাষ্ট্রের আইন মান্য করতেই হবে আপনি যেই ব্যাবস্থার শাসনেই থাকেন না কেন। অতএব এইটা কোন বাঁধা না রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ইসলাম কায়েম এ। কেননা, ইসলামি রাষ্ট্রে করের পরিধি কম হবে কারণ এই ব্যাবস্থায় সবাই রাষ্ট্রের জন্য কাজকে এবাদত হিসেবে গণ্য করে ও আল্লাহ্‌ এর কাছে সকল কাজের হিসাব দিতে হবে মনে করে তাই সবাই দুর্নিতি থেকে বিরত থাকে। বায়তুল মাল থেকে টাকা গায়েব হয়না, তাই কম টাকায় বেশি কাজ হয়।

 

রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে মুসলিম দের বিশেষ ব্যবস্থার প্রশ্নের উত্তরঃ

প্রকৃত ইসলামে স্বজনপ্রীতি ছিলোনা, উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় খলিফা উমর (রঃ) এর ছেলে আবু শামা এর কথা। মদ্যপানের অভিযোগে অভিযোক্ত হলে সমান সাস্থি পেতে হয়েছিলো। আরেকটা উদাহরণ দেই, খলিফা উমর (রঃ) একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন, এক সাহাবা দাঁড়িয়ে বললেন আগে আমার একটা কথার উত্তর দিন এর পর খুতবা দিন। বাইতুল মাল থেকে আমরা সকলে অর্ধেক থুব (ঢিলা আলখাল্লা) এর কাপড় পেয়েছি কিন্তু আপনি কিভাবে পূর্ন নতুন থুব পড়ে আছেন? তখন খলিফা তাঁর ছেলেকে এর উত্তর দিতে বলেন। উনার ছেলে বলে, আমি আমার অর্ধেক থুব এর কাপড় বাবাকে দিয়েছি তাই বাবা পূর্ন থুব বানাতে পেরেছেন।

আশা করি স্বজন প্রীতির ভীতি দূর হয়েছে। ইসলামে এটা পাপ গণ্য হয় তাই প্রকৃত মুসলেম স্বজনপ্রীতি করেনা, অতএব অন্য ধর্মালম্বিদের ভয়ের কোন কারণ নেই।

প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্নঃ ইসলামিক বাংলাদেশ হলে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে “খলিফা” পদ্ধতি চালু হবে। যেহেতু ইসলামে নারী খলিফা হবার কোন বিধান বা নজির নাই।


উত্তরঃ প্রথমেই আপনাকে এটা মেনে নিতে হবে যে গণতন্ত্রের মতো ইসলাম ও একটা রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি। গণতন্ত্রের যেমন রাষ্ট্র পরিচালনায় তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে তেমনই ইসলামের ও তাঁর নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। গণতন্ত্রের শাসন ব্যাবস্থার আইন তৈরি ও কার্য পরিচালনার মূল উৎস পার্লামেন্ট বা সংসদ আর ইসলামের শাসন ব্যাবস্থার মূল উৎস মসজিদ। কে শাসন করবেন সেটা নারী নাকি পুরুষ এটা অন্য ধাপ কিন্তু পার্লামেন্ট এর বদলে মসজিদ হবে শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। নারী মূল শাসনে আসেনি (এমাম বা নেতা যেটাকে খলিফা হিসেবে মানুষ জানে, আসলে সকল মানুষ ই খলিফা – সুরা আল বাকারাহ আয়াত ৩০) মূলত ইসলামের শাসন কার্যের এর ইউনিক পদ্ধতির ফলে। ইসলাম শাসন করে সেনা বাহিনীর প্রধান দ্বারা। আর এই প্রধান হওয়ার কাজটা নারীদের দ্বারা হওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ প্রচুর অধ্যাবসা করে ওই পদে আধিষ্ট হতে হয়, আর যুদ্ধের কঠিন কাজ তো আছেই। তাই দেখা যায় ইসলামের শাসন মূলত পুরুষ ই করে থাকে, যেহেতু নারীদের এতো কঠোর কাজ করার সুযোগ কম। কিন্তু ইতিহাস বলে অনেক পদে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো, তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নারী সাহাবার বাজারের সভাপতি হওয়া, নারীর নার্স হওয়া, এমনকি কিছু যুদ্ধে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের নজির ও আছে। তাই, ইসলাম নারীকে পিছিয়ে রাখে এটা বলা যাবেনা।

গণতন্ত্রের শাসন পার্লামেন্ট এর হলে ইসলামের মসজিদ হতে পারবে না এমন কোন যুক্তি হতে পারেনা। বরং মসজিদ হলে অন্তত একটা বিষয় জনগণের লাভ ই হবে সেটা হোল আলাদা খরচ কমে যাবে, এতে করে জনগণের উপর কর এর চাপ কমবে।

অতএব, পার্লামেন্ট না থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেহেতু আটকে থাকছেনা সেহেতু ইসলাম শাসন এ আসতে চাইলে পার্লামেন্ট এইটা কোন বাঁধা নয়।